মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন
মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে আপনি হয়তো অনেক খোঁজাখুঁজি করেছেন। আজকের এই আর্টিকেলটির মধ্যে মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ চাষের বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারবেন। এছাড়াও মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছের যে বিভিন্ন রকম সুবিধা রয়েছে সেটি সম্পর্কেও জানতে পারবেন।
অন্যান্য মাছের তুলনায় মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষ করলে খুব অল্প পুঁজিতে লাভবান হওয়া যায়। মনোসেক্স তেলাপিয়ার চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে আজকের আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
ভূমিকা
অন্যান্য মাছ চাষের তুলনায় খুব অল্প পুঁজিতে মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ চাষ করা যায়। এই মাছ চাষ করতে বেশি পানির প্রয়োজন হয় না তিন থেকে চার ফুট পানিতে এই মাছ চাষ করা যায়। এছাড়াও মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ যে কোন খাবার খায় ফলে খাবারের খরচ কম হয়। এই মাছ উচ্চ ফলনশীল হয়ে থাকে এবং খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু।
মনোসেক্স তেলাপিয়া কি
তেলাপিয়া মাছ আমাদের সুস্বাদু পূর্ণ একটি মাছ। যা আমরা অনেকেই পছন্দ করে থাকি।মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানার আগে মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ কি জানতে হবে। সকল মাছের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় স্ত্রী প্রজাতির মাছ আকারে বড় হয় এবং পুরুষ প্রজাতির মাছ আকারে ছোট হয়। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় স্ত্রী প্রজাতির মাছেরা ডিম দেয়।
কিন্তু তেলাপিয়া মাছের ক্ষেত্রে সেটি ঘটে না। তেলাপিয়া মাছের স্ত্রী মাছের তুলনায় পুরুষ মাছটি আকারে বড় হয়। পুরুষ মাছে ডিম ধারণ না করার কারণে মাছের মাসল ও পেশী অত্যাধিক থাকে। ফলে বেশি পরিমাণে প্রোটিন পাওয়া যায়। এর কারণে তেলাপিয়া মাছটি কোন লিঙ্গের তা নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না, এই সময় হরমোনযুক্ত খাবার বেশি পরিমাণে সরবরাহ করে সকল তেলাপিয়া পোনাকে পুরুষে পরিণত করা হয়। এটাকেই বলা হয় মনোসেক্স তেলাপিয়া।
মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষের সুবিধা
মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছের চাষের সুবিধা অনেক। কারণ মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ খুব অল্প সামান্য পুঁজিতে চাষাবাদ করা যায়। নিম্নে মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ চাষের সুবিধা সম্পর্কে তুলে ধরা হলোঃ
- মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ উচ্চ ফলনশীল।
- মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ খেতে অত্যান্ত সুস্বাদু।
- মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ অল্প গভীর পানিতে অর্থাৎ ৩-৪ ফুট পানিতে চাষ করা যায়।
- মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ যে কোন খাবার পছন্দ করে ফলে সব ধরনের খাবার দেয়া যায়।
- মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ চাষের বড় সুবিধা হচ্ছে এই মাছ সহজে রোগাক্রান্ত হয় না।
- মাছ চাষে ভুলনামূলক ভাবে কম খরচ ও সহজ ব্যবস্থাপনায় বেশী মাছ উৎপাদন পাওয়া যায়। যার ফলে লাভ বেশি হয়।
- মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ চাষ করতে বেশি পুঁজির প্রয়োজন হয় না খুব অল্প পুঁজিতে চাষ করা যায়।
মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষ পদ্ধতি
মনোসেক্স তেলাপিয়ার চাষ দুই ধাপে করা ভালো। কেননা আমাদের দেশে হ্যাচারী থেকে সাধারণত ২৫-৩০ দিন বয়সের পোনা সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এই বয়সের পোনা সাধারণত কেজি প্রতি ৮,০০০-১০,০০০টি পোনা থাকে। তাই এ পোনাকে মজুদ পুকুরে সরাসরি মজুদ না করে প্রথমে নার্সারি পুকুরে মজুদ করতে হয়। নার্সারি পুকুরের আয়তন ১০-৩০ শতাংশ এবং পানির গভীরতা সর্বোচ্চ এক মিটার হলে ভাল হয়। সারা বৎসর পানি থাকে এবং মৌসুমী উভয় ধরনের পুকুর এ মাছ চাষের জন্য নির্বাচন করা যায়।
নার্সারী পুকুরে মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষ পদ্ধতি
মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষ পদ্ধতির মধ্যে নার্সারি পুকুরে চাষ এটি একটি পদ্ধতি। মনোসেক্স তেলাপিয়া নার্সারী পুকুরে চাষের কিছু করণীয় রয়েছে যা নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ
পুকুর শুকানোঃ আতুর পুকুর অবশ্যই প্রতি বৎসর শুকাতে হবে।
আগাছা দমনঃ পুকুরে কোন ধরনের আগাছা রাখা যাবে না। তাই পুকুরে কোন আগাছা থাকলে সেগুলি অবশ্যই পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।
পাড় মেরামতঃ পুকুরের পাশাপাশি পুকুরের পাড় ভালোভাবে মেরামত করা প্রয়োজন। তাই আতুর পুকুরের পাড় ভাংগা বা অপরিষ্কার থাকলে তা সঠিক ভাবে মেরামত করতে হবে।
চুন প্রয়োগঃ প্রতি শতাংশে ১-২ কেজি হারে চুন পুকুরের তলায় এবং পাড়ের যতটুকু অংশে পানি উঠবে ততটুকু অংশে ভালভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে।
পানি প্রয়োগঃ চুন প্রয়োগের পর পুকুরে ২.৫-৩ ফুট পানি দিতে হবে। পানি অবশ্যই পরিষ্কার হতে হবে এবং পানির গুণাগুণ ভাল হতে হবে।
পাড়ে নেট প্রয়োগঃ পাড়ে নেট দেওয়া ও আতুর পুকুরের চার পাশ ভালভাবে নেট দিয়ে ঘিরে দিতে হবে। যাতে করে সাপ, ব্যাঙ, পাখি ইত্যাদি পুকুরে প্রবেশ করে পোনা খেয়ে ফেলতে না পারে।
পোনা মজুদঃ শতাংশ প্রতি ২০০০ থেকে ২২০০টি হারে পোনা মজুদ করা যেতে পারে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে সকল পোনা যেন একই আকার ও বাসের হয়। ভিন্ন আকার ও বয়সের পোনা মজুদ করলে ফলাফল ভাল হয় না। এজন্য ফিশগ্রেডার ব্যবহার করা যেতে পারে। নার্সারি পুকুরে পোনাকে সাধারণত এক থেকে দেড় মাস চাষ করতে হয়।
মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছের খাবার তালিকা
নার্সারী পুকুরে মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছের পোনা মজুদের পর থেকে নিম্নে উল্লেখিত হারে প্রতি দিন পোনাকে খাবার দিতে হবে।
- ১ম ৩-৪ দিন মজুদকৃত পোনার দেহওজনের সমান অর্থাৎ ১০০% হারে।
- এরপর ৫-৮ দিন পোনার দেহ ওজনের ৬০-৭০%।
- এরপর ৯-১২ দিন পোনার দেহ ওজনের ৪০-৫০%।
- এরপর ১৩-২০ দিন পোনার দেহ ওজনের ২০-২৫%।
- এরপর ২১-৩০ দিন পোনার দেহ ওজনের ১৫-২০%।
- এরপর ৩০-৪৫ দিন পোনার দেহ ওজনের ১০-১২%।
খাদ্যের পরিমাণ পানির তাপমাত্রা, পোনার আকার ইত্যাদির উপর নির্ভর করে কম-বেশি হতে পারে। মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষের জণ্য পানির তাপমাত্রা ২২-২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস সবচেয়ে উপযুক্ত। পোনার খাদ্য প্রথমদিকে মিহি গুড়া হতে হবে এবং এতে ৪০% প্রোটিন থাকতে হবে।
তবে পোনা বড় হয়ে গেলে ছোট আকারের পিলেট খাবার খাওয়ানো যাবে এবং এতে ৩২-৩৬% প্রোটিন থাকতে হবে। খাবার দিনে ৩/৪ বার করে দিতে হবে। এ ভাবে চাষ করলে প্রতিটি পোনার ওজন ২০-২৫ গ্রাম হবে। তখন একে মজুদ পুকুরে স্থানান্তর করতে হবে।
মনোসেক্স তেলাপিয়া মজুদ পুকুরে চাষ
মনোসেক্স তেলাপিয়া মজুদ পুকুরে পোনা ছেড়ে চাষ করা যায়। যে কোন আয়তনের পুকুরে মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ চাষ করা যায়। তবে পুকুরের আয়তন ২০-১০০ শতাংশ হলে উত্তম। এ মাছ চাষের জন্য পুকুরে পানির গভীরতা ৩.৫-৪.৫ ফুট হলে ভাল হয়। মনোসেক্স তেলাপিয়া মজুদ পুকুরে তিন থেকে চার মাস চাষ করে বাজারজাত করা যায়।
তাই চার থেকে পাঁচ মাস পানি থাকে এমন পুকুরও এ মাছ চাষের জন্য নির্বাচন করা যায়। কাজেই সারা বৎসর পানি থাকে এবং মৌসুমী উভয় ধরনের পুকুর এ মাছ চাষের জন্য নির্বাচন করা যায়।
মজুদ পুকুর প্রস্তুতিঃ মনোসেক্স তেলাপিয়ার মজুদ পুকুরের প্রস্তুতি অন্যান্য মাছ চাষের পুকুরের মতই। তবে পানির গভীরতা ৩.৫-৪.৫ ফুট এর মধ্যে হতে হবে।
মজুদ পুকুরে পোনা মজুদ ও চাষঃ শতাংশ প্রতি ১৭৫ থেকে ২২৫টি হারে ২০-২৫ গ্রাম আকারের পোনা মজুদ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রেও লক্ষ্য রাখতে হবে সকল পোনা যেন একই আকার ও বয়সের হয়। ভিন্ন আকার ও বয়সের পোনা মজুদ করলে ফলাফল ভাল পাওয়া যাবে না। এজন্যও ফিশগ্রেডার ব্যবহার করা যেতে পারে।
মজুদ পুকুরে খাবারঃ মাছ মজুদের পর প্রতিদিন মাছকে উচ্চ প্রোটিনযুক্ত (২৮-৩০%) খাবার খাওয়াতে হবে। প্রথম এক মাস পোনার দেহ ওজনের ৬-৮% হারে ও পরবর্তী মাসগুলিতে ৪-৬% হারে খাবার খাওয়াতে হবে। পিলেট জাতীয় ভাসমান খাবার সবচাইতে ভাল। এ ছাড়া রাইচ ব্রান, খৈল, ফিশমিল ইত্যাদি দিয়েও খাদ্য প্রস্তুত করা যেতে পারে, তবে এতে খাদ্যের গুণাগুণ ও মাছের বৃদ্ধি ততটা ভাল হয় না।
এক্ষেত্রেও খাদ্যের পরিমাণ পানির তাপমাত্রা, পোনর আকার ইত্যাদির উপর নির্ভর করে কম-বেশি হতে পারে। মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষের জন্য পানির তাপমাত্রা ২২-২৮° সেলসিয়াস সবচেয়ে উপযুক্ত। এজন্য পানির তাপমাত্রা ও অন্যান্য গুণাগুণ উপযুক্ত মাত্রায় রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। মজুদ পুকুরে পোনাকে সাধারণত তিন থেকে চার মাস চাষ করলে মনোসেক্স তেলাপিয়া ২৫০-৩০০ গ্রাম আকারের হয়, যা বাজারজাতকরণের জন্য উপযুক্ত।
লেখকের মন্তব্য
প্রিয় পাঠক, এতক্ষণ আজকের এই আর্টিকেলটি ধৈর্য সহকারে পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আজকের আর্টিকেলটির মধ্যে মনোসেক্স তেলাপিয়া পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আপনি কিভাবে খুব কম পুঁজিতে মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ চাষ করবেন তা আশা করি ইতিমধ্যে জানতে পেরেছেন।
যেহেতু মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ অল্প পুঁজিতে চাষ করা যায় তাই ব্যাপকভাবে লাভবান হতে পারবেন। এছাড়াও মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছের রোগ বালাইও কম তাই অন্যান্য মাছের তুলনায় মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষে খরচ নেই বললেই চলে। আজকের এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনি যদি বিন্দুমাত্র উপকৃত হয়ে থাকেন।
তাহলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে তাদেরকেও মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দিন। আশা করি আজকের এই পোস্টটি আপনি সম্পূর্ণ মনোযোগ সহকারে পড়েছেন। আপনার যদি কোন মতামত এবং প্রশ্ন থেকে থাকে তাহলে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে আমাদেরকে জানাতে পারেন। আর হ্যাঁ ওয়েবসাইটটি নিয়মিত ভিজিট করতে ভুলবেন না। আপনার প্রতিটা মুহূর্ত সুন্দর হোক-আসসালামু আলাইকুম
এখানে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url